বৃহস্পতিবার, ২৪ নভেম্বর, ২০১৬

আরবলের বাদশা মালিক মুজাফর জয়নুদ্দীন রহমাতুল্লাহি আলাইহি উনার প্রতি আরোপিত ওহাবীদের মিথ্য অপবাদের দাঁতভাঙ্গা জবাব


বাদশা হযরত মালিক মুজাফফরুদ্দীন ইবনে যাইনুদ্দীন রহমতুল্লাহি আলাইহি ছিলেন অনেক বড় আলেম, এবং মুত্তাকী ব্যক্তি। যুগশ্রেষ্ঠ সকল  উলামায়ে কিরাম উনার ভূয়ষি প্রশংসা করেছেন।

প্রসঙ্গে আল্লামা হযরত ইবনে কাছীর রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি  লিখেন-
كان يصرف على الـمولد كل سنة على ثلاثة الف دينار
অর্থাৎ “আরবলের বাদশা হযরত মালিক মুজাফফরুদ্দীন ইবনে যাইনুদ্দীন রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি প্রতি বছর পবিত্র ঈদে মীলাদুন নবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উপলক্ষে তিন লক্ষ দিনার ব্যায় বা খরচ করতেন।” (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া ১৩তম খ-, ১৩৭ পৃষ্ঠা) সুবহানাল্লাহ! সে সময়ের তিন লক্ষ দিনার বর্তমানে কত টাকা হবে তা চিন্তা-ফিকির করতে হবে। হাবীবুল্লাহ হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার প্রতি বেশুমার মুহব্বত থাকলেই এমনটা করা সম্ভব।

স্মর্তব্য যে, ওহাবীরা উক্ত বাদশাকে ঈদে মীলাদুন নবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উপলক্ষে প্রচুর পরিমাণে খরচ করার কারণে অপচয়কারী বলে থাকে। নাউযুবিল্লাহ!
মূলত: ওহাবীরা এতটাই জাহিল যে, অপচয় কাকে বলে সেটাই তারা জানেনা। বস্তুত: মীলাদ শরীফ মাহফিল বা ঈদে মীলাদুন নবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উপলক্ষে খরচ বা ব্যয় করা অপচয় নয়। বরং অশেষ ফযীলত ও জান্নাত লাভের কারণ। যেমন এ প্রসঙ্গে আফদ্বালুন নাস বা’দাল আম্বিয়া খলীফাতু রসূলিল্লাহ হযরত আবূ বকর ছিদ্দীক আলাইহিস সালাম তিনি বলেন-
من انفق درهـما على قرائة مولد النبى صلى الله عليه وسلم كان رفيقى فـى الـجنة
অর্থাৎ “যে ব্যক্তি মীলাদ শরীফ অথবা ঈদে মীলাদুন নবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উপলক্ষে এক দিরহাম (প্রায় ৬০০ টাকা) খরচ করবে, সে আমার সাথে জান্নাতে থাকবে। (আন নি’মাতুল কুবরা আলাল আলাম ৭ পৃষ্ঠা)
আর তাই বিশ্বের সকল বিখ্যাত ও অনুসরণীয় ও সর্বজনমান্য ও শ্রদ্ধেয় ইমাম-মুজতাহিদ রহমতুল্লাহি আলাইহিম উনারা এক বাক্যে উক্ত বাদশার ভূয়সী তা’রীফ বা প্রশংসা করেছেন। যেমন এ প্রসঙ্গে হাফিযে হাদীছ হযরত ইমাম যাহাবী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি উনার বিশ্বখ্যাত ইতিহাস গ্রন্থে “লিখেন-
كان متواضعا خيرا سنيا يـحب الفقهاء والـمحدثين
অর্থঃ- “বাদশা হযরত মালিক মুজাফফরুদ্দীন ইবনে যাইনুদ্দীন রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি নম্র, ভদ্র, বিনয়ী ও উত্তম স্বভাবের অধিকারী ছিলেন। তিনি আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াতের আক্বীদায় বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি ফক্বীহ ও মুহাদ্দিছগণকে অত্যন্ত ভাল বাসতেন।” (সিয়ারু আলামিন্ নুবালা”- ২২তম জিঃ ৩৩৬ পৃষ্ঠা)
এ মহান বাদশার প্রশংসায় উনার সমকালীন বিখ্যাত ইতিহাসবিদ আল্লামা ক্বাযী ইবনে খাল্লিক্বান রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার বিখ্যাত কিতাবে লিখেন-
وكرم الاخلاق كثير التواضع حسن العقيدة سالـم البطاقة شديد الـميل الى اهل السنة والـجماعة لا ينفق عند من ارباب العلوم سوى الفقهاء والـمحدثين ومن عداهـما لا يعطيه شيا الا تكلفا.
অর্থঃ- বাদশা হযরত মুজাফফরুদ্দীন ইবনে যাইনুদ্দীন রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি প্রশংসনীয়, উত্তম চরিত্রের অধিকারী, অত্যাধিক বিনয়ী ছিলেন। উনার আক্বীদা ও বিশ্বাস ছিল সম্পূর্ণ বিশুদ্ধ। তিনি আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াতের একনিষ্ঠ অনুসারী ছিলেন। তিনি আলিম-উলামা, ফক্বীহ ও মুহাদ্দিছগণ উনাদের পিছনে ব্যয় করা ব্যতীত সকল ক্ষেত্রেই ব্যয় করার ব্যাপারে মিতব্যয়ী ছিলেন।(ওয়াফইয়াতুল আ’ইয়ান ৪র্থ জিঃ ১১৯ পৃষ্ঠা) 

বিখ্যাত তাফসীরকারক ও ইতিহাসবেত্তা আল্লামা হযরত ইমাদুদ্দীন ইবনে কাছীর রহমতুল্লাহি আলাইহি লিখেন-
الـملك الـمظفر ..... ابو سعيد كوكبرى احد للاجواد السادات الكبراء والـملوك الامـجادلة اثر حسنة
অর্থঃ “বাদশা হযরত মুজাফফরুদ্দীন ইবনে যাইনুদ্দীন আবূ সাঈদ কাওকাবারী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি অত্যধিক দানশীল ও নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের অন্যতম একজন ছিলেন। সাথে সাথে তিনি সম্মানিত বাদশাও ছিলেন। উনার বহু পূন্যময় কাজের আলামত এখনও বিদ্যমান রয়েছে।”(আল বিদায়া ওয়ান্ নিহায়া”-এর ১৩তম জিঃ ১৩৬ পৃষ্ঠা)  এ মহান বাদশা বিশুদ্ধ আক্বীদা ও উত্তম আমলের অধিকারী ছিলেন বলে এবং তিনি যে তরতীবে মীলাদ শরীফ-এর মাহফিল উদযাপন করতেন তা শরীয়ত সম্মত ছিল বলেই সে যামানার প্রায় সকল আলিম-উলামা, পীর-মাশায়িখ, ছুফী-দরবেশ, ক্বারী, ওয়ায়িয উক্ত মীলাদ শরীফ-এর মাহফিলে উপস্থিত হতেন। 

এ প্রসঙ্গে ইমাম ইবনে খাল্লিক্বান রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার  কিতাবে লিখেন-
واما احتفال بـمولد النبى صلى الله عليه وسلم فان الوصف يقصر عن الاحاطة بـها ولكن نذكر طرقا منه وهو اهل البلاد كانوا قد سـمعوا بـحسن اعتقاد فيه فكان فى كل سنة يصل اليه من البلاد العربية من اربل مثل بغداد والـموصل والـجزيرة وسنجار ونصبين وبلادا العجم وتلك النواحى حلق كثير من الفقهاء والصوفية والوعائظ والقراء والشعراء
অর্থঃ “বাদশা হযরত মুজাফফরুদ্দীন ইবনে যাইনুদ্দীন রহমতুল্লাহি আলইহি কর্তৃক আয়োজিত মীলাদ শরীফ-এর মাহফিলের গুরুত্ব-মাহাত্ব বলে শেষ করার মত নয়। এতদসত্ত্বেও একটি কথা না বললেই নয়। তাহলো দেশবাসী আক্বীদা ও বিশ্বাসে উনাকে উত্তম লোক বলে জানতেন। আর তাই প্রতি বছর আরবলের নিকটবর্তী সকল দেশে যেমন- বাগদাদ, মাওছিল, জাযীরাহ, সানজার, নাছীবাইন, আরব-অনারব ও তার আশ-পাশের অসংখ্য আলিম-উলামা, ফক্বীহ, ছালিহ, ওয়ায়িয, ক্বারী ও শায়িরগণ উক্ত মীলাদ শরীফ-এর মাহফিলে উপস্থিত হতেন।” (ওয়াফইয়াতুল আ’ইয়ান” ৪র্থ জি: ১১৭ পৃষ্ঠা) সুবহানাল্লাহ!

হাফিজুল হুফফায, ইমামুল মুহাদ্দিসীন, আল্লামা, ইমাম হযরত জালালুদ্দীন সুয়ূতী রহমতুল্লাহি আলাইহি “আল হাবীলিল ফতওয়া” নামক কিতাবে বর্ণনা করেন, “সর্বপ্রথম যিনি এই প্রকার মীলাদ মাহফিলের প্রবর্তন করেন, তিনি হলেন আরবালের বাদশাহ্ মালিক মুজাফফর আবূ সাইদ বিন জয়নুদ্দীন।” ইমাম সুয়ূতী রহমতুল্লাহি আলাইহি উক্ত বাদশাহ্ সম্বন্ধে উনার কিতাবে সুপ্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক ও মুহাদ্দিছ আল্লামা ইবনে কাছীর রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছেন যে,

ﻭﻛﺎﻥ ﺷﻬﻤﺎ ﺷﺠﺎﻋﺎ ﺑﻄﻼ ﻋﺎﻟﻤﺎ ﻋﺎﺩﻻ ﺭﺣﻤﻪ ﺍﻟﻠﻪ ﻭﺍﻛﺮﻡ ﻣﺜﻮﺍﻩ

অর্থ: “তিনি তীক্ষ্ম বুদ্ধি-সম্পন্ন, সাহসী, বীর্যবান, আলিম ও ন্যায় বিচারক ছিলেন। আল্লাহ্ পাক উনার প্রতি রহম করুন উনাকে সম্মানিত বাসস্থান দান করুন।” (হুসনুল মাকাসিদফি আমালিল মাওয়ালিদ)
শায়খ হাফিয আবুল খত্তাব ইবনে দাহইয়া বাদশাহর এই মীলাদ অনুষ্ঠান সম্পর্কে এক বৃহৎ কিতাব
প্রণয়ন করে তার নাম দিয়েছেন, “আততানবীরু ফী মাওলিদিল বাশীর ওয়ান নাযীর।”ঐতিহাসিক ইবনে খাল্লেকান হাফিয আবুল খত্তাব ইবনে দাহইয়ার পরিচয় দিতে গিয়ে “তারীফে ইবনে খাল্লেকানে” লিখেছেন, “তিনি তৎকালীন বিখ্যাত ও নেতৃস্থানীয় আলিম বিদ্বানগণের মধ্যে অন্যতম ছিলেন। তিনি পশ্চিমের কোন এক দেশ হতে আগমন করে শাম ও ইরাক সফর করেন এবং হিজরী ৬০৪ সালে ‘আরবল’ শহরে আগমন করে সেখানেই অবস্থান করেন। তখনকার বাদশাহ্ মালিক মুজাফফরকে মীলাদুন্নবীর প্রতি যথেষ্ট আগ্রহান্বিত ও যত্নপরায়ণ দেখে উনার এই কর্মের সমর্থনে ﺍﻟﺘﻨﻮﻳﺮ নামক একটি কিতাব প্রণয়ন করেন।” প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস আল্লামা ইবনু জাওজী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার নাতি ‘মিরআতুজ্জামান’ নামক পুস্তকে বলেন, “তাঁর (বাদশাহর) আয়োজিত মীলাদ মাহফিলে শীর্ষস্থানীয় ছূফী ও আলিমগণ উপস্থিত হতেন।”

অনুরূপ বিবরণ বিখ্যাত গ্রন্থ “সীরাতে শামী, সীরাতে হালবীয়া, সীরাতে নববীয়া ও যুরকানী” ইত্যাদিতেও বিদ্যমান আছে ।


0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন