আমাদের সমাজে কিছু লোক বের হয়েছে, তারা
মানুষকে ধোঁকা দেয়ার জন্য বলে বেড়ায় প্রত্যেক বিদয়াতই গোমরাহী। এরা হয় বিদয়াত কি জিনিস,
কাকে বলে, এর ব্যাখ্যা কোনটাই জানে না অথবা জেনে শুনে মানুষকে ধোঁকা দিতে এটা বলে থাকে।
তাই বিদয়াত বিষয়ে সংক্ষেপে কিছু আলোচনা করা যাক।
বিদয়াত বা
নতুন উদ্ভাবিত বিষয় বলতেই ইসলামী শরীয়তের মধ্যে পরিত্যাজ্য নয়। বিদয়াত সম্পর্কে বুঝতে
হলে প্রথমেই বিদয়াতের শাব্দিক ও পারিভাষিক অর্থ জানতে হবে, অতঃপর জানতে হবে বিদয়াত কত প্রকার ও কি কি? কোনটি গ্রহণযোগ্য ও কোনটি পরিত্যাজ্য।
বিশ্ববিখ্যাত
ও নির্ভরযোগ্য লুগাতের কিতাবসমূহে বিদয়াত শব্দের লুগাতী অর্থ সম্পর্কে উল্লেখ আছে যে, بدعة অর্থাৎ নতুনত্ব, নতুন মত, নতুন পদ্ধতি, নতুন বস্তু, নব উদ্ভাবিত, নব আবিষ্কার ইত্যাদি।
(মিছবাহুল লুগাত, মুনজিদ, ফিরুযুল লুগাত, বায়ানুল লিসান, লুগাতে হীরা, গিয়াছুল লোগাত)
এ সম্পর্কে
বিখ্যাত মুহাদ্দিছ ও ফক্বীহ আল্লামা হযরত বদরুদ্দীন আইনী হানাফী রহমতুল্লাহি আলাইহি
তিনি লিখেছেন-
والبدعة
فى الاصل
احداث امر
لم يكن
فى زمن
رسول الله
صلى الله
عليه وسلم.
অর্থ: “প্রকৃতপক্ষে
বিদয়াত হলো- এরূপ নতুন উদ্ভূত বিষয়, যা আখিরী রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার
সময় ছিলো না।” (উমদাতুল ক্বারী শরহে বুখারী ৫ম জিলদ্ পৃষ্ঠা ৩৫৬)
আজকাল কিছু জাহিল লোক সকল বিদয়াতকেই (নতুন উদ্ভাবিত
পদ্ধতি) গোমরাহী বলে থাকে এবং দলীল হিসাবে তারা নিম্নোক্ত হাদীস শরীফখানা পেশ করে
থাকে । যেমন হাদীছ শরীফে ইরশাদ করা হয়েছে,
كل بدعة ضلالة وكل ضلالة فى النار.
অর্থঃ- “প্রত্যেক বিদয়াতই গোমরাহী, আর প্রত্যেক গোমরাহ লোকই জাহান্নামে
যাবে।”
এ প্রসঙ্গে
বিখ্যাত মুহাদ্দিছ হযরত মুল্লা আলী ক্বারী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার বিশ্ব বিখ্যাত কিতাব
মিশকাত শরীফের শরাহতে “উল্লেখ করেন,
ما
احدث مما
يخالف الكتاب
او السنة
او الاثر
او الاجماع
فهو ضلالة
وما احدث
مما لا
يخالف شيأ
مما ذكر
فليس بمذموم.
অর্থ: “হযরত
ইমাম শাফিয়ী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বলেন, যে নব উদ্ভাবিত কাজ পবিত্র কুরআন শরীফ, পবিত্র হাদীছ শরীফ, আছার (অর্থাৎ হযরত
ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু আনহুম উনাদের আমল বা ক্বওল) অথবা পবিত্র ইজ্মা শরীফ উনার
বিরুদ্ধ বলে প্রমাণিত, তাই গুমরাহী ও নিকৃষ্ট।
আর যে নব উদ্ভাবিত কাজ উল্লেখিত কোনোটির বিপরীত বা বিরুদ্ধ নয়; বরং পবিত্র কুরআন শরীফ, পবিত্র হাদীছ শরীফ, পবিত্র ইজমা শরীফ
ও পবিত্র ক্বিয়াস শরীফ উনাদের সম্মত, তা মন্দ বা নাজায়িয নয়।” (মিরকাত শরীফ” ১ম জিলদ ১৮৯ পৃষ্ঠা)
এ সকল লোকেরা বিদয়াতের ব্যাখ্যা সম্পর্কে নেহায়েতই অজ্ঞ । এ হাদীস শরীফের
ব্যাখ্যা মেশকাত শরীফের শরাহ্ মেরকাত শরীফে উল্লেখ করা হয়,
–
“সাহেবে মেরকাত হযরত মোল্লা আলী ক্বারী রহমতুল্লাহি আলাইহি
বলেন, “আল
আজহার” নামক কিতাবে كل بدعة ضلالة হাদীস শরীফের এ অংশটুকুর ব্যাখ্যা
এভাবে করা হয়েছে, “সকল বিদয়াতে সাইয়্যিয়াই গোমরাহী ।”
হযরত ইমাম
শারানী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বলেন, “প্রত্যেক নব উদ্ভাবিত পদ্ধতিই যে নিকৃষ্ট বা নিষিদ্ধ হবে, তার কোনো যুক্তি নেই।” (আনওয়ারে কুদসিয়্যাহ)
আর তাই শায়খ ইব্রাহীম হালবী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন,-
“নতুন উদ্ভাবিত কোন কাজ হযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লাম, হযরত সাহাবা-ই-কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু
তাবেয়ীনগণের নিকট হতে প্রমাণিত না থাকলে অথবা উক্ত কাজের প্রতি বিদয়াত শব্দ
আরোপিত হলেই যে, তা মন্দ বা গোমরাহী একথা যুক্তিযুক্ত নয়,
বরং তা ভালও হতে
পারে ।” (কবীরী শরহে মুনিয়াতুল মুসল্লী পৃঃ২৫১)
এ বিষয়টা
হাদীস শরীফেই বলা হয়েছে,
مَنْ
سَنَّ فِي
الإِسْلاَمِ سُنَّةً
حَسَنَةً فَلَهُ
أَجْرُهَا وَأَجْرُ
مَنْ عَمِلَ
بِهَا بَعْدَهُ
مِنْ غَيْرِ
أَنْ يَنْقُصَ
مِنْ أُجُورِهِمْ
شَىْءٌ
হযরত জারীর
ইবনে আব্দুল্লাহ বাজালী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বর্ণনা করেন, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ
করেন,
‘যে ব্যক্তি দ্বীন ইসলামে কোন উত্তম বিষয় বা আমলের
প্রচলন করলো, তার জন্য প্রতিদান বা ছওয়াব রয়েছে
এবং তার পরে যারা এই আমল করবে তাদের জন্য ছওয়াব বা প্রতিদান রয়েছে, অথচ এতে তাদের ছওয়াবের কোন কমতি করা হবে না।’ (মুসলিম শরীফ
- কিতাবুজ যাকাত : হাদীস ১০১৭, সুনানে নাসাঈ ২৫৫৪, জামে তিরমিযী
- কিতাবুল ইলিম : হাদীস শরীফ ২৬৭৫ )
সূতরাং
ইসলামে নতুন কোন বিষয় চালু হলেই তা বিদয়াত বলে পরত্যাজ্য নয়। কারন এ বিষয়ে স্বয়ং
হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার কওলী হাদীছ শরীফ বিদ্যমান। অর্থাৎ
কেউ যদি নতুন কোন আমল চালু করে যা শরীয়ত সম্মত ও উত্তম সেটা মূলত সুন্নত। কারন এ
ধরনের আমলের মূল ভিত্তি ইসলামে থাকে। হাফেজ ইবনে রজব রহমতুল্লাহি আলাইহি লিখেছেন,
“বিদয়াত ঐ বিষয়কেই বলা হয়, যার ভিত্তি শরীয়তে নেই। সুতরাং
শরীয়তে যে বিষয়ের ভিত্তি রয়েছে, শরীয়ত মুতাবেক তা বিদয়াত নয়,
যদিও আভিধানিক
অর্থে বিদয়াত বলা হয় ।” (জামিউল উলূম ওয়াল হাকাম পৃঃ১৯৩,
ইরশাদুল উনূদ
পৃঃ১৬১)
আরো একটা হাদীস হাদীস শরীফ তারা পেশ করে–
من احدث
قى
امرنا هذا ما ليس منه فهورد.
অর্থ-“যে ব্যক্তি আমার এ দ্বীনের ভিতরে কোন নতুন জিনিস উদ্ভাবন করবে,
যার ভিত্তি এ
দ্বীনে নেই, সেটা অবশ্যই পরিত্যাজ্য ।”
এ হাদীস শরীফের ব্যাখ্যায় মোযাহেরে হক্ব ১ম খন্ড ৭০ পৃষ্ঠায় উল্লেখ রয়েছে,
হাদীছ শরীফে ,-
ما ليس منه
শব্দ ব্যবহার হয়েছে- উদ্দেশ্য এই যে, যে সকল কাজ কুরআন শরীফ ও সুন্নাহ শরীফের
বিরুদ্ধ নয়, সেগুলোকে বিদয়াতের গন্ডি বহির্ভূত করে রাখা । কারণ এ সকল
কাজ নতুন উদ্ভুত হলেও গোমরাহী বা নিকৃষ্ট নয় ।
বিদয়াত কথা লিখা হলেও, নতুন কিছু আমল
হলেও তা পরিত্যাজ্য হয়ে যায় না, বরং সুন্নত ও হতে পারে। কারন, আখিরী রসূল,
নূরে মুজাসসাম,
হাবীবুল্লাহ হুযূর
পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার মুবারক যামানায় তারাবীহ নামায উনার জামায়াত
হতো না। হযরত উমর ফারূক আলাইহিস সালাম উনার সময় তা শুরু হয় এবং এর সৌন্দর্য দর্শনে
পুলকিত হয়ে তিনি মন্তব্য করেন,
نعمت البدعة هذه
অর্থাৎ “ইহা উত্তম বিদয়াত।” (ফতহুল বারী শরহে বুখারী
কিতাবুছ ছলাতিত তারাবীহ, মিশকাত শরীফ, মিরকাত শরীফ)
বিদয়াত হলেই
যদি গোমরাহী বা
পরিত্যাজ্য হয় তবে হযরত
উমর আলাইহিস সালাম
উনার উনার আমল কি
গোমরাহী ছিলো?
মোটেও নয়, বরং তা সুন্নত। হাফেজ ইবনে রজব রহমতুল্লাহি আলাইহি লিখেছেন,“বিদয়াত ঐ বিষয়কেই বলা হয়,
যার ভিত্তি
শরীয়তে নেই। সুতরাং শরীয়তে
যে বিষয়ের ভিত্তি রয়েছে, শরীয়ত মুতাবেক
তা বিদয়াত নয়, যদিও আভিধানিক অর্থে বিদয়াত বলা হয় ।” (জামিউল উলূম
ওয়াল হাকাম পৃঃ১৯৩, ইরশাদুল উনূদ
পৃঃ১৬১)
দেওবন্দীদের মুরুব্বী রশিদ আহমক গাঙ্গুহী তার ফতাওয়ারে রশিদীয়াতে লিখেছে, “বিদয়াত কোন হাসানা হয় না, যাহাই হাসান বলা হয় তাই
সুন্নত নামে অভিহিত। ইহা এস্তেলাহেব প্রকারভেদ মাত্র, কিন্তু উভয়ের মর্ম একই। (ফতোয়ায়ে রশিদীয়া ২৮৮ পৃষ্ঠা)
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন